রাইফেল রোটি আওরাত

রাইফেল রোটি আওরাত

“রোটি (রুটি) খেয়ে গায়ের তাকত বাড়াও, আর রাইফেল ধরে প্রতিপক্ষকে খতম কর, তারপর আওরাত (নারী) নিয়ে ফুর্তি কর।”

রাইফেল, রোটি, আওরাত। এই তিনটি বিচ্ছিন্ন, কিন্তু কোনোভাবে যেন সংযোগপূর্ণ শব্দগুলো দিয়ে তৈরী নামের এ বইটির মূল বিশেষত্ব সম্ভবত এর ‘রচনাকাল’। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপন্যাসগুলোর মাঝে এবং মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে রচিত বইগুলোর মাঝে এটিই একমাত্র, যেটি কিনা – মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে রচিত – মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক উপন্যাস।

১৯৭১ এর এপ্রিল মাস থেকে শুরু করে জুন মাস অব্দি লেখা এ বইয়ের ঘটনাবলী ২৫ মার্চের কালরাত্রি থেকে শুরু হয়ে জুন মাস অব্দি আবর্তিত হলেও, মূল ঘটনা এবং বর্ণনা মুক্তিযুদ্ধের প্রথম তিনটি দিনকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে।

কালরাত্রির ভয়াবহতার পর কোনোভাবে বেঁচে যাওয়া ঢাবি প্রফেসর সুদীপ্ত শাহীনকে কেন্দ্র করে বইটির ঘটনাপ্রবাহ আগাতে থাকলেও, পাঠক বইটি পাঠ শুরুর কিছুক্ষণ পরেই বুঝতে পারবেন, এর কেন্দ্রীয় চরিত্রটি আদতে লেখকেরই প্রতিচ্ছবি। তৎকালীন ঢাবি প্রফেসর লেখক অধ্যাপক আনোয়ার পাশা মুক্তিযুদ্ধের ধংসস্তুপে দাঁড়িয়ে তাঁর নিজ দৃষ্টিতে দেখা পাক বাহিনীর নিষ্ঠুরতা, বর্বরতা, ভয়াবহ নৃশংসতার বর্ণনাই ঘুরে ফিরে তুলে ধরেছেন পুরো বইটি জুড়ে। তাঁর এমন বাস্তবিক বর্ণনায় একেবারে গভীর ভাবে অবলোকন করা যায় সে সময়ের বাস্তবতাটা।

২৫শে মার্চের ভয়াল কালরাত্রি, এবং এর পরের দিনগুলোতে বারেবারে দেখা মিলেছে ভালোবাসা, বিশ্বাস, নিষ্ঠা, আবার, সমান্তরালেই থেকে যাওয়া স্বার্থপরতা, প্রতিহিংসা, বর্বরতার।
পেশায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক মূল চরিত্রের পাশাপাশি আমরা অন্য আরেক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক চরিত্রের দেখা পাই, যিনি সংগ্রাম বা বিশ্বাসের প্রতীক হওয়ার বদলে হয়েছেন বিপরীতটিই। এই বিপরীত চরিত্রটির পাকিস্তান মিলিটারি বিষয়ে করা একটি সংলাপে হয়তো পাঠক তাকে পরিপূর্ণভাবে চিনতে পারবেঃ

“আর্মির জেনারসিটি দেখুন, মেয়েদের ফেরত পাঠাবার সময় সঙ্গে চিকিৎসার জন্য তিনশো টাকাও দিয়েছে। দে আর কোয়াইট সেন্সিবল ফেলো।”

এত ভয়াবহতার মাঝেও লেখকের স্যাটায়ারিকাল বর্ণনাগুলো পাঠককে যেমন হাসায়, তেমনি তার পেছনের রূঢ়তাটাও উপলব্ধি করতে বাধ্য করায়। এমন এক পরিস্থিতিতে অবস্থান করে লেখক কী করে ঠান্ডা মাথায় বইটি লিখেছিলেন, তা আসলেই একটি ভাববার মত বিষয়।

বইটি লেখক শেষ করেছিলেন –

“নতুন মানুষ, নতুন পরিচয় এবং নতুন একটি প্রভা। সে আর কতো দূরে। বেশি দূর হতে পারে না। মাত্র এই রাতটুকু তো। মা ভৈঃ। কেটে যাবে।”

-কথাটির সাথে।

তবে, এখানে বলে রাখা ভালো, লেখকের সৌভাগ্য হয়নি নতুন পরিচয়ে নতুন একটি প্রভায়, বাংলাদেশ নামক নতুন দেশটির বিজয় দেখে যাওয়ার।
কারণ, ১৯৭১ সালের ১৪ই ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যাযজ্ঞে শহীদ হন এ বইটির লেখক শহীদ অধ্যাপক আনোয়ার পাশা

LEAVE A COMMENT

Your email address will not be published. Required fields are marked *